আজ চৈত্র অবসান

ঈশানের পুঞ্জমেঘ অন্ধবেগে ধেয়ে চলে আসে/ বাধাবন্ধহারা/ গ্রামান্তরে বেণুকুঞ্জে নীলাঞ্জনছায়া সঞ্চারিয়া/ হানি দীর্ঘধারা।/ বর্ষ হয়ে আসে শেষ, দিন হয়ে এল সমাপন,/ চৈত্র অবসান/ গাহিতে চাহিছে হিয়া পুরাতন ক্লান্ত বরষের/ সর্বশেষ গান।/… ধাও গান, প্রাণভরা ঝড়ের মতন ঊর্ধ্ববেগে/ অনন্ত আকাশে।/ উড়ে যাক, দূরে যাক বিবর্ণ বিশীর্ণ জীর্ণ পাতা/ বিপুল নিশ্বাসে।… আজ বাংলা বছরের শেষ দিন, কালের পরিক্রমায় বিদায় নেবে ১৪২৫ বঙ্গাব্দ। চৈত্র মাসের শেষ দিনটিকে বলা হয় চৈত্র সংক্রান্তি। বাংলার বিশেষ লোকজ উৎসব। চৈত্র থেকে বর্ষার প্রারম্ভ পর্যন্ত সূর্যের যখন প্রচণ্ড উত্তাপ থাকে তখন সূর্যের তেজ প্রশমন ও বৃষ্টি লাভের আশায় কৃষিজীবী সমাজ বহু অতীতে চৈত্র সংক্রান্তির উদ্ভাবন করেছিল। এক সময় গ্রামীণ জনপদের প্রধান উৎসব হলেও কালের প্রবাহে এটি এখন নাগরিক জীবনেও স্থান করে নিয়েছে। এ উপলক্ষে দেশজুড়ে এখন চলে নানা ধরনের মেলা, উৎসব। হালখাতার জন্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সাজানো হয়, আয়োজন করা হয় শোভাযাত্রাসহ নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। বর্ষবিদায় উপলক্ষে আজ নগরীতে থাকছে ব্যাপক আয়োজন। আগামীকাল সকালে ভোরের প্রথম আলো রাঙিয়ে দেবে নতুন স্বপ্ন, প্রত্যাশা আর সম্ভাবনাকে। শুরু হবে নতুন বাংলা বর্ষ ১৪২৬।
চৈত্র সংক্রান্তি উপলক্ষে দেশের অন্যান্য অঞ্চলের আদিবাসীদের পাশাপাশি কঙবাজার এবং পাবর্ত্য জেলা রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানের বিভিন্ন জাতি-উপজাতির মধ্যেও উৎসব-অনুষ্ঠান প্রচলিত রয়েছে। এ উৎসব শুরু হয় চৈত্র সংক্রান্তি ও নববর্ষের বেশ কদিন আগেই। পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন নৃ-গোষ্ঠীর লোকজন বিভিন্ন নামে এ উৎসব পালন করলেও রীতিনীতি ও ধরন প্রায় একই। এটি পার্বত্য চট্টগ্রামে সম্মিলিতভাবে ‘বৈসাবি’ নামে উদযাপিত হয়ে আসছে ১৯৮৫ সাল থেকে। ত্রিপুরাদের বৈসুক শব্দ থেকে ‘বৈ, মারমাদের সাংগ্রাই থেকে ‘সা’ এবং চাকমা ও তঞ্চঙ্গ্যাদের বিঝু ও বিষু শব্দ দু’টি থেকে ‘বি’ আদ্যাক্ষরগুলোর সমন্বয়ে ‘বৈসাবি’ উৎসবের নামকরণ করা হয়েছে। আজ শনিবার পালিত হবে চাকমাদের ‘মূল বিজু’, ত্রিপুরাদের ‘বুইসুকমা’। এ উৎসবে প্রতিটি বাড়িতেই তৈরি করা হয় পায়েস, বিনিভাত সহ নানা ধরনের ও স্বাদের সুস্বাদু সব খাবার যা নিজেরা খাওয়ার পাশাপাশি অতিথিদেরও আপ্যায়ন করা হয়। চৈত্রের শেষ দিন আজ আদিবাসী তরুণ-তরুণীরা নদী থেকে পানি এনে বাড়ির বয়োজ্যেষ্ঠদের স্নান করিয়ে আশীর্বাদ নেবে। মারমাদের ‘সাংগ্রাই’-এর মধ্য দিয়ে বৈসাবির পুরো আয়োজন শেষ হবে আগামী ১৮ এপ্রিল।
চৈত্র সংক্রান্তির একটি আকর্ষণ হলো পাঁচন। পাঁচন সাধারণত হরেক রকমের শাক-সবজির মিশ্রণ। মনে করা হয় যে বছরের শেষ ঋতু পরিবর্তনের সময় বিভিন্ন শাক-সবজি দিয়ে রান্না করা পাঁচন খেলে পরের বছর রোগ-বালাই থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে। এ পাঁচনের প্রচলন আছে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে শুরু করে চট্টগ্রামেও। নগরীর বিভিন্ন ঘরে শাক-সবজির মিশ্রণ এ পাঁচন তৈরি করে শুধু নিজেরাই উপভোগ করা নয় বিলি করা হয় আত্মীয়-প্রতিবেশীদের মাঝেও। পাঁচন তৈরির উপকরণ নানারকম শাক-সবজি বিক্রি করা হয় নগরীর রেয়াজউদ্দিন বাজার, হাজারি গলি, চৌমুহনীর কর্ণফুলী বাজারসহ অন্যান্য বাজারগুলোতেও। বড় বাজারগুলোর পাশাপাশি পাঁচন তৈরির উপকরণ এখন বিক্রি হয় নগরীর বিভিন্ন অলি-গলিতে বসা অস্থায়ী বাজারেও।
বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণ উপলক্ষে নাড়ু, আটকড়াই, ছাতু ইত্যাদি পাওয়া যায় রেয়াজউদ্দিন বাজার, বকশির হাটসহ বিভিন্ন বাজারে ও দোকানে। এ উৎসবে বাঙালির ঐতিহ্যবাহী খাবার বিভিন্ন রকমের নাড়ু বেশ জনপ্রিয়। এগুলোর মধ্যে আছে তিলের নাড়ু, কুলের নাড়ু, নারকেলের নাড়ু, চালের নাড়ু, মুড়ির নাড়ু, খইয়ের নাড়ু।
নগরীর মোগলটুলী বড়ুয়া পাড়ার গৃহিনী নিভা বড়ুয়া জানান, একটা সময় ছিল যখন গ্রামে গ্রামে বেশি পরিমাণ পাঁচন ও নানারকমের নাড়ু তৈরি হতো যা কাছের আত্মীয়-স্বজন ও প্রতিবেশীদের মাঝে বিলি করার পাশাপাশি পাঠানো হতো দূর-দূরান্তের আত্মীয়-স্বজনদের পরিবারেও। আধুনিকতার কারণে এখন মানুষ শহরমুখী হয়ে যাওয়ায় গ্রামে পাঁচন ও নাড়ু তৈরি অনেকটাই কমে এসেছে। এখন তাই অনেকেই এগুলো ঘরে তৈরি না করে বাজার থেকে কিনে এনেই আনুষ্ঠানিকতা সারে।
নগরীর পার্সিভিল হিল এলাকার ব্যাংকার মোহাম্মদ শামীম আরিফ বলেন, চৈত্র সংক্রান্তিতে বড়দের পাশাপাশি আমাদের ছেলেমেয়েরাও খুব আনন্দ করে কারণ তার পরদিনই আসে বাংলা নববর্ষ। বাসায় তৈরি করা হয় মুড়ির মোয়া যা ছোটবড় সবার কাছেই খুব প্রিয়। চিড়া, খই, নাড়ু ইত্যাদি কিনে আনি বকশির হাট থেকে। বাচ্চারা এদিন তাদের বন্ধু-বান্ধবদেরও নিমন্ত্রণ করে বাসায়। চৈত্র সংক্রান্তি ও বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে নগরীর বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে আয়োজন করা হয় নানা অনুষ্ঠানের।
নববর্ষ উদযাপন পরিষদ সিআরবি চত্ত্বরে শিরীষতলায় বর্ষবিদায়ের আয়োজন করেছ্‌ে। আজ শনিবার বিকাল ৪টায় বর্ষবিদায়ের আনুষ্ঠান শুরু হবে।
সম্মিলিত ১লা বৈশাখ উদযাপন পরিষদ আজ শনিবার বিকাল ৪টা থেকে একটা সম্মিলিত তবলার সঙ্গত দিয়ে শুরু হবে। জেলা শিল্পকলা একাডেমির অনিরুদ্ধ বড়ুয়া (অনি) মুক্তমঞ্চে দু’দিনব্যপী আয়োজন করা হয়েছে বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের। আজ শনিবার বিকাল ৪টায় বর্ণাঢ্য র‌্যালির মাধ্যমে বর্ষ বিদায়ের অনুষ্ঠানের সূচনা করা হবে। চট্টল ইয়ুথ কয়ার বর্ষবিদায়ের অনুষ্ঠান পালন করবে চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলে শিশু উৎসবের মাধ্যমে। আজ বিকাল ৪টায় বর্ষবিদায়ের অনুষ্ঠান শুরু হবে।
বাংলা বর্ষ ১৪২৫ এর বিদায় ও ১৪২৬ বর্ষবরণ উপলক্ষ্যে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, কঙবাজার জেলা দুই দিন ব্যাপী বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানমালা হাতে গ্রহণ করেছে। চৈত্র সংক্রান্তির অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বাংলা বর্ষকে বিদায় জানানো হবে। আজ সন্ধ্যা ৬টায় কঙবাজার পাবলিক লাইব্রেরীর শহীদ দৌলত ময়দানে বর্ষ বিদায়ের অনুষ্ঠানে কঙবাজার তবলা ইনস্টিটিউট, কঙবাজার শিল্পীগোষ্ঠী, সত্যেন সেন শিল্পীগোষ্ঠী, অংকুর সংগীত একাডেমী, দরিয়া নগর শিল্পীগোষ্ঠী, জাগো বাংলাদেশ ও বিজয় মুখ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশন করবে।